December 22, 2024
ইতিহাস

ঠগি – সর্বকালের বিপজ্জনক ডাকাত গোষ্ঠী

ঠগি সর্বকালের সেরা বিপদজনক ডাকাত গোষ্ঠী যারা নিরীহ ভ্রমণকারীদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ও গলায় হলুদ গিট দেয়া রুমাল পেচিয়ে নির্মম ভাবে মেরে ফেলতো। শত শত বছর ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় হারিয়ে যেত অগণিত পথিক। কোথায়, কিভাবে হারাত সেটি জানত না কেউ। কোন এক জাদুবলে যেন তারা মুছে যেত পৃথিবীর বুক থেকে_ ঐতিহাসিকদের মতে, সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি ও তার পরের কয়েকশ’ বছরে প্রতি বছর গড়ে হাজার চল্লিশেক মানুষ নিখোঁজ হতো। গিনেস বুক অব রেকর্ডসের হিসাবে এ সংখ্যা মোট ২০ লাখ! নিরীহ পথিকদের হত্যা করে মালামাল যারা লুট করত _ ভারতীয় কিংবদন্তিতে আমরা তাদের ঠগি বলে চিনি।
ঠগি ১৭ ও ১৮ শতকের প্রথমদিকে ভারতের পথিকদের জন্য মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। এরা সব সময় চলত দলবেঁধে। একলা পথিক পেলেই সাদরে তাকে দলের সঙ্গে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানাত। সহযাত্রীদের সৌহার্দ্যের নিরাপত্তা আর বিশ্বাসের উষ্ণ আমেজে, পথচলার ক্লান্তিতে ঢলে পড়ত শিকার। গরম খাবার পেটে পড়ায় বন্ধ হয়ে আসত চোখ। আর তখনই আসত সর্দারের হুকুম, বাসন মেজে আনার!

কারা ঠগি? বাংলা অভিধানে ঠগি বলতে বোঝায় বিশেষ শ্রেণীর দস্যু দল, যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে হত্যা করত। ঠগি বলতে আরও বোঝায়_ ঠগির কার্য, দস্যুবৃত্তি। ঠগি শব্দটি সংস্কৃত ঠগ শব্দ থেকে এসেছে। ঠগ অর্থ-ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক। ভারত শাসনের সূত্রে যেসব শব্দ ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়েছে ঞযঁফ (থাড) সেসবের একটি। শব্দটির মানে, ধপ করে পড়া বা আঘাত করা। এ শব্দটি সংস্কৃত ঠগি শব্দ থেকে এসেছে। ঠগিরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলাসহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তৎকালীন প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র তীর-ধনুক কিংবা লাঠি-বল্লম নয়, আগ্নেয়াস্ত্র তো নয়ই; অস্ত্র বলতে শুধু একটি হলুদ রংয়ের সাদামাটা রুমাল। রুমালটি ভাঁজ করার পর তার দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় মাত্র ৩০ ইঞ্চি। ১৮ ইঞ্চি দূরে একটি গিঁট আর অন্যদিকে একটি রুপার টাকা কিংবা দুটো তামার আধুলি বাঁধা থাকত। এ অস্ত্র দিয়েই ওরা হাজার হাজার নিরীহ পথচারী, বণিক, তীর্থযাত্রীকে মেরে ফেলে তার সর্বস্ব লুট করে মাটিতে পুঁতে দিত।

ঠগিদের সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকার প্রথম জানতে পারে ১৮১২ সালে। রাজ্যের নানা স্থানে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার সংবাদ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায়। কর্তৃপক্ষ প্রথম প্রথম বিষয়টি আমলে নেয়নি, ভেবেছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ১৮১২ সালের দিকে গঙ্গার ধারে একটি গণকবরে একত্রে প্রায় ৫০টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। গণকবরটি পরীক্ষা করে দেখা গেল, মৃতদেহগুলো যাতে ভালো করে মাটির সঙ্গে মিশে যায় সেজন্য অত্যন্ত সচেতনভাবে কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, হাড়ের সন্ধিস্থলগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে, যাতে পচন প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয় ও কবর ফুলে না ওঠে এবং মৃতদেহগুলো শেয়ালে না খায়। এসব বিচার-বিশ্লেষণ করে ব্রিটিশ তদন্ত দল ও কর্তৃপক্ষ অনুমান করে গণহত্যার পেছনে রয়েছে একদল সঙ্গবদ্ধ খুনি। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ঠগি নামে এক গোষ্ঠীর কথা। এরা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়, যাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। তারপর সময়-সুযোগ মতো পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর গোপনে মৃতদেহ সমাহিত করে। যে কারণে কেউ ঠগিদের আক্রমণে মারা গেলে বিষয়টি অজানা থেকে যেত। লোকে ভাবত হতভাগ্য লোকটি পথিমধ্যে জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণের শিকার হয়েছে।

কিন্তু যখন বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ পর্যটক নিখোঁজ হতে শুরু করে তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে ও তদন্ত শুরু হয়।জানা যায়, হত্যাকারীরা একটি কালী উপাসক গোষ্ঠী। বাংলার ঠগিরা কালীকে ভবানী বলত। তবে ঠগিরা কেবল সনাতন ধর্মেরই অনুসারী নয়, এদের মধ্যে মুসলিম ও শিখও ছিল! ঠগিরা বংশপরম্পরায় খুন ও দস্যুবৃত্তি করত। ছোটবেলা থেকেই ঠগিরা শিখত কীভাবে শ্বাসরোধ করে ফাঁস দিয়ে হত্যা করতে হয়। বংশপরম্পরা বা শিক্ষানবিসের মাধ্যমে দলে সদস্যদের নেওয়া হতো। ঠগি বালকের শিক্ষা শুরু হতো ১০ বছর বয়সে। তখন সে লুকিয়ে হত্যাকাণ্ড দেখত। বয়স ১৮ হলে নতুন ঠগি সদস্যরা হত্যার অনুমতি পেত। সাধারণত শক্ত কাপড়ের তৈরি হলুদ রংয়ের রুমাল দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা হতো। হলদে রুমাল থাকত ঠগিদের কোমরে। এ সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বিবাহ প্রথারও প্রচলন ছিল। সারাবছরই ঠগিরা সাধারণ মানুষের মতো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘর-সংসার করত। শরতের শুরুতে ওরা দলবেঁধে পথে নামত। তখন ওরা অন্য মানুষ, অর্থাৎ ভ্রাম্যমাণ খুনি! এটাই তখন ওদের একমাত্র পরিচয়। শীত শেষ হলেই সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে তারা ঘরে ফিরে আসত।

সব ঠগিদের দলেই একজন দলনেতা বা সর্দার থাকত। দলনেতাকে বলা হতো জমাদার। সবাই তাকে মেনে চলত। শিকার করার পর যা পাওয়া যেত তা সবাই সমানভাগে ভাগ করে নিত। এমনকি দলে কেউ অনুপস্থিত থাকলেও তার ভাগ ঠিকমতো পেয়ে যেত। ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার ‘কালিঘাট’ ও বিন্ধ্যাচলের ‘ভবানী মন্দির’। ঠগিরা সাধারণত ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রীর কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমণ করত। এদেরই লোকজন গোপনে বাজার কিংবা সরাইখানা থেকে পথযাত্রীদের সম্বন্ধে খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করত। তারপর সুকৌশলে সেই যাত্রীদের সঙ্গে মিশে যেত এবং যাত্রাবিরতিতে হত্যাকাণ্ড ঘটাত। একজন যাত্রীকে খুন করত তিনজনের একটি দল। একজন মাথা ঠেলে দিত, অন্যজন ফাঁস পরাত, আরেকজন পা চেপে ফেলে দিত। কেউ পালিয়ে গেলেও রক্ষা নেই, কাছেপিঠেই ওঁত পেতে থাকত ঠগিদের অন্য কোনো দল। তবে ঠগিরা সবাইকে হত্যা করত না। যেমন_ ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক ও নারীদের হত্যা নিষেধ ছিল। তবে ব্যবসায়ীদের স্ত্রীদের হত্যা করা হতো।

ঠগিদের ছিল নিজস্ব ভাষা, বিভিন্ন এলাকায় ঠগিদের ছিল বিভিন্ন নাম। যেমন_ জলের ঠগিদের নাম পাঙ্গু, নদী-নালার ঠগিদের নাম আবার ভাগিনা। কোথাও কোথাও এদের নাম ছিল, ‘আরিতুলুকর’, কোথাও ‘তন্তাকালেরু’ কোথাও ‘ফাঁসুড়ে’ ইত্যাদি। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম থাকলেও এদের হত্যা করার পদ্ধতি ছিল অভিন্ন। এদের মধ্যে নিয়ম ছিল কোথাও রক্তপাত করা চলবে না। ঠগিদের এলাকাও ভাগ করা থাকত। নেহায়েত দরকার না হলে কেউ কারও সীমানা অতিক্রম করত না। দরকার মতো এরা দলে সদস্য সংখ্যা কমাত কিংবা বাড়াত। শিকার ধরার সময় দরকার হলে হেঁটে পাড়ি দিত শত শত মাইল। তিন-চারটি দলে ভাগ হয়ে এরা শিকার ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়ত। যে কোনো সংগঠিত অপরাধী সমাজের মতো নিজস্ব সাংকেতিক ভাষাও ছিল ঠগিদের। তাদের ভাষার নাম ছিল ‘রামসি’। নানারকম সংকেতও ব্যবহার করত তারা। ঠগিদের গোষ্ঠীভুক্ত না হলে এ ভাষা বা সংকেতের পাঠোদ্ধার ছিল অসম্ভব।ঠগিদের দলের আগে আগে চলত ‘সোথা’রা। সম্ভাব্য শিকার চিহ্নিত করে প্রাথমিক পর্যায়ে ভাব জমানো ছিল তাদের কাজ। ইতিমধ্যে দলের খানিকটা পেছনে চলতে শুরু করবে ‘তিলহাই’রা। গুপ্তচর ও পুলিশের গতিবিধি নজরে রাখত তারা। ‘নিসার’ বা নিরাপদ জায়গা দেখে তাঁবু গাড়া হতো। খাবার পর বাসন মাজার অতি স্বাভাবিক নির্দেশ। কিন্তু ‘বিয়াল’ বা কবর তৈরি করার দায়িত্ব যার, সে জানত সময় এগিয়ে আসছে। এবার ‘ঝিরনী’ উঠবে অর্থাৎ হত্যার আদেশ আসবে। সে আদেশ হলো ‘তামাকু লাও’। এক লহমায় ফাঁস জড়াবে শিকারের গলায়। ‘চামোচি’ ধরে থাকবে শিকারকে। ‘চুমোসিয়া’ তার হাত আটকে রাখবে, যাতে সে বাধা দিতে না পারে। ‘চুমিয়া’ তার পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে। তারপর ‘ভোজারা’ দেহগুলোকে নিয়ে যাবে কবরে। ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হলো দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুঁতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেওয়া, মৃতদেহ যাতে ফুলে উঠে কবর থেকে বেরিয়ে না পড়ে। সাদা কাপড়ের ফালি নিয়ে পাহারায় থাকবে ‘ফুরকদেনা’। বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেবে এরাই। এরপর অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় জায়গাটা সাফসুতরো করে ফেলবে ‘ফুরজানা’। এ রকম আরও কিছু ভাষার নমুনা হলো, খৌর (ঠগির সাম্ভাব্য শিকার), বাজিত খান (কাজ শেষ), সোথাই (ভিনদেশী অচেনা পথিকদের বশ করা যার কাজ), তাইওয়া (পথিক দল) ইত্যাদি।

সংস্কার-কুসংস্কারের বেড়াজালে সদ্য মৃত মানুষদের কবরের ওপর বসবে ঠগিদের অমৃতের ভোজ। আসলে ভোজ আর কিছুই নয়, গুড়ের ভোজ। কিন্তু তাদের সংস্কার ছিল, ‘এ গুড় মন্ত্রপূত প্রসাদ। যে একবার খাবে, সে ঠগি হয়ে যাবে। ঠগিদের খুনের অস্ত্রটা ছিল অদ্ভুত। অতি সাধারণ, কিন্তু কি সাংঘাতিক কার্যকর। এক ফালি হলদে কাপড়ের টুকরো। দুই ভাঁজে ভাঁজ করলে মাত্র ৩০ ইঞ্চি। ১৮ ইঞ্চির মাথায় একটা গিঁট। তাতে একটা রুপার টাকা বা তামার ডবল পয়সা বাঁধা। নিপুণ ঘাতকের হাতে সেটাই হয়ে উঠবে অব্যর্থ মরণ ফাঁস। আর ফাঁসের আগে সেই ফাঁদ পাতার গল্প। বিভিন্ন ভূমিকা আর দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাদারি শ্রম বিভাজনের কাঠামো তৈরি করেছিল ঠগিরা। দলের প্রত্যেক সদস্যের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল। ঠগিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সব ধর্মের লোকই ছিল, কিন্তু সবাই তারা কালীর নামে শিকারে রেরুত। তারা বিশ্বাস করত শিকার তারা বেছে নেয় না, শিকারকে নির্দিষ্ট করে তাদের কাছে উৎসর্গ করে পাঠিয়ে দিতেন কালী মা। তারা নিজেদের ঠগি ধর্ম পালন করত শুধু। তারা নিমিত্ত মাত্র। তাই হত্যা করার পরও তাদের মনে কোনো পাপবোধ বা অনুশোচনা হতো না। এ বিশ্বাস থেকেই শিকার ঘিরে এক বিশাল সংস্কারের কাঠামো তৈরি করেছিল ঠগিরা। কবর খোঁড়ার কোদাল, মৃতদেহকে কেটে ভাঁজ করার ছুরি, হলদে রুমাল সবকিছুকেই সুদীর্ঘ পদ্ধতি আর উপচারের মধ্য দিয়ে শুদ্ধ, মন্ত্রপূত করে নেওয়া হতো।

ঠগিরা ছিল বাংলাদেশেও!
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ঠগিদের হত্যাকাণ্ড তুঙ্গে উঠলেও ১৩ শতক থেকেই উত্তর ভারতে ঠগিদের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। আর বাংলায়? অনুমান করা যায় ঠগিরা পূর্ব দিল্লির আশপাশে ছিল এবং ১২৯০ সালের পর বাংলায় আসে। ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘সুলতানের শাসনামলে (১২৯০) কয়েকজন ঠগিকে দিল্লিতে আনীত হইয়াছিল এবং উক্ত সংঘের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া আরও সহস্র ঠগিকে আটক করা হয়। সভাসদরা চাইলেও সুলতান তাহাদের হত্যার নির্দেশ দেন নাই। সুলতান উহাদিগকে নৌকায় করিয়া লক্ষণাবতীতে পাঠাইয়া দিতে নির্দেশ দেন, যেন তাহারা আর দিল্লি এবং তার আশপাশে গোলযোগ না করে।’ এখন প্রশ্ন হলো লক্ষণাবতী কোথায়? লক্ষণাবতী বা লক্ষ্নৌতি হলো গৌড় বাংলা। যা অবস্থিত ছিল বর্তমান ভারতের পশ্চিমবাংলার মালদা জেলায়। সে হিসাবে বাংলায় ঠগিদের ইতিহাসের সূত্রপাত ১২৯০ সাল থেকেই। সেসময় বাংলাদেশ ছিল নদীনালায় ভরা। তারপরও বাংলার মানুষ ঠগির আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। বাংলার নদীনালার ঠগিদের নাম ছিল ‘ভাগিনা’। ভাগিনারা জলপথে আক্রমণের জন্য বেছে নেয় ভিন্ন কৌশল। জলপথে ঠগিদের শিকার করার পদ্ধতি ছিল অন্যরকম। তারা লোকজনে ভরা কোনো খেয়াঘাটে যাত্রী সেজে নৌকা নোঙ্গর করে বসে থাকত। দলের কিছু লোক ডাঙ্গায় ফাঁদ পাততো। তারা যাত্রীদের কৌশলে নৌকায় এনে তুলত। নির্জন যায়গায় নৌকা পৌঁছালে ছইয়ে যারা বসে আছে তারা ইঙ্গিত দিত এবং হাল বাওয়া ঠগি পাটাতনে তিনবার বৈঠা ঠেকাত। এই সংকেত পাওয়ামাত্রই ছইয়ে এবং পাটাতনের যাত্রীদের ওপর শুরু হয়ে যেত ঠগিদের আক্রমণ। অথবা ঠগিরা দেখল কোনো বেপারির নৌকা ভেসে যাচ্ছে। তখন ঠগিরা তাদের সঙ্গে ভাব জমাত। এরপর দুই-তিন দিন একসঙ্গে নৌকা চলা; একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া। ঠিক হতো সন্ধ্যাবেলা গানের আসর বসবে। সেই মতো আয়োজন হতো। ঠগিরা শিকারের চারপাশে গোল হয়ে বসত। গান যখন জমে উঠত তখনই হত্যার নির্দেশ জারি হতো। ব্যাস মুহূর্তেই সব শেষ। ফের যাত্রা শুরু হতো।

এখনো ঠগিরা বেঁচে আছে ইতিহাসের পাতায় আর লোকমুখে। এদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন এক ইংরেজ সেনা, নাম ‘ফিরিঙ্গি ঠগি, হেনরি শ্লিম্যান’! ১৮৩০-এর দশকে ভারতে প্রশাসক হিসেবে এসেছিলেন উইলিয়াম হেনরি শ্লিম্যান। ঠগি দমনে তার উৎসাহ আর নিষ্ঠার ফলে যার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ঠগি শ্লিম্যান’ অথবা ‘ ফিরিঙ্গি ঠগি’। ১৮২২ সালে উইলিয়াম শ্লিম্যান বেঙ্গল আর্মির অফিসার ছিলেন। পরে তিনি সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন; তাকেই গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং শ্বাসরুদ্ধকারী ঠগিদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন। চারটি ভারতীয় ভাষা জানা শ্লিম্যান অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। উইলিয়াম শ্লিম্যানই সর্বপ্রথম ঠগিদের কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে আঁচ করতে পারেন। তিনি জানতেন ঠগিদের দমন করা সহজ নয়। কেননা, অন্যান্য দুষ্কৃতকারীদের থেকে ঠগিদের আলাদা করা যাচ্ছিল না। তাছাড়া সুকৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিল তারা। উইলিয়াম শ্লিম্যান গুপ্তচর নিয়োগ করেন, গঠন করেন পুলিশ ফোর্স। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ও দ্রুত বিচার আদালত গঠন করেন। এর পাশাপাশি শ্লিম্যান ঠগিদের অপরাধস্থল সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে নকশা তৈরি করেন এবং অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকা তৈরি করেন; যার ফলে তিনি পরবর্তী গণহত্যার সময়কাল আঁচ করতে সক্ষম হন। নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ পাঠান। এভাবে ১৮৩০ থেকে ১৮৪১ সালের মধ্যে ৩ হাজার ৭০০ ঠগি ধরা পড়ে।

ঠগি এবং ডাকাতদের নির্মূল করার জন্য বৃটিশ পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স টোকেন

ঠগিদের জিজ্ঞাসাবাদের ফলে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। যেমন_ মাত্র ২০ জনের একটি দল ৫ হাজার ২০০ পথযাত্রীকে হত্যা করে। এদের মধ্যে এক ঠগি সর্দার বেহরাম; সে ১৭৯০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১২০০টি খুন করে! তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এর জন্য তার অনুশোচনা হয় কিনা? উত্তরে বেহরাম নির্বিকার কণ্ঠে বলেছিল, ব্যবসার জন্য কারা আক্ষেপ করে! সেসময় ৫০০ জনের মতো ঠগির ফাঁসি হয়, বাকিদের দ্বীপান্তর অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ফাঁসিকাষ্ঠে ঠগিরা ছিল অভিব্যক্তিশূন্য। বরং তারা কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস দিয়ে মৃত্যুর আবেদন করে, যেভাবে তারা নিরীহ যাত্রীদের হত্যা করত। ঠগিদের দীর্ঘ বিচারপর্বে উঠে এল অনেক কাহিনী, যাতে স্তম্ভিত হলো সভ্যসমাজ। ঠগিদের জবানবন্দি থেকে খুনের একটা সম্ভাব্য হিসাবও পাওয়া গেল। ১৯৩৩ সালে শ্লিম্যানের নাতি জেমস শ্লিম্যানের লেখা থেকে জানা যায়, একজন ঠগি গড়ে মাসে ৮ থেকে ১০ জন খুন করত। ২০ বছর ধরে সে যদি এ কাজ করে আর এ সংখ্যাকে ভারতে ঠগির সংখ্যা দিয়ে গুণ করা হয়, তাহলে সংখ্যাটা কম করে হলেও ২০ থেকে ৩০ লাখ হতে পারে। ১৮৪০ দশকে ঠগিদের বিচারের পর তাদের কথা আর খুব বেশি শোনা যায়নি। এরপর ঠগিদের স্থান হয় গল্প, উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে। হলিউড চলচ্চিত্র ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দি টেমপল অব ডুমস’-এ ঠগিদের দেখানো হয়। সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ এ ছবিতে বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা অমরেশপুরী কালী উপাসক ঠগি চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের গোঁসাইপুর সরগরম উপন্যাসেও ঠগিদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা পদ্ধতি বর্ণিত আছে। তবে এখনো ভারতের রাজস্থানে ঠগি বংশধরদের দেখতে পাওয়া যায়, যদিও তারা এখন স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করে।

Courtesy- সন্দীপন বসু মুন্না

Let's share this post
error: