December 19, 2024
ইতিহাসপোস্ট কার্ড

পোস্টকার্ড যখন ইতিহাস ও আবেগের কেন্দ্রবিন্দু

Written by – Tareq Aziz

আজ হতে ১২০ বছর আগের পোস্টকার্ডে ঢেঁকিতে ধান ভানার ছবিটি ঢাকায় তোলা। ১৯০০ সালের এই পোস্টকার্ডটি ঢাকার ছবিযুক্ত পোস্টকার্ডের প্রাচীনতম নিদর্শন। দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন জার্মান আলোকচিত্রী ফ্রিৎজ ক্যাপ। কার্ডটি ততকালীন বোম্বে বন্দর থেকে পোস্ট করা হয়েছিল বিলাতের উদ্দেশ্যে। বর্তমানে এটি ব্রিটিশ লাইব্রেরির সাবেক কর্মকর্তা জনাব গ্রাহাম শ’এর ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে।

পূর্বকথাঃ পোস্টকার্ড প্রবর্তনের দেড়শত বছর পূর্তি হল গত বছর। ১৮৬৯ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যে সুলভ ডাক যোগাযোগের প্রয়োজনে প্রথম পোস্টকার্ডের প্রচলন হয়। ব্রিটিশ ভারতে পোস্টকার্ড চালু হয় আরো ১০ বছর পর, ১৮৭৯ সালে। হলুদাভ এই কার্ডগুলোর একপাশে সংক্ষিপ্ত চিঠি লিখে অপরপাশে প্রাপকের ঠিকানা লিখতে হত। মাত্র কোয়ার্টার আনায় (এক আনায় চার পয়সা) বিশাল ভারতবর্ষের যেকোনো প্রান্তে পৌঁছে যেত সেই কার্ড। খুব অল্প সময়েই যোগাযোগের এই মাধ্যম তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। কর্মজীবি মানুষেরা কর্মক্ষেত্র থেকে দূরদূরান্তে নিজ নিজ পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখতে ব্যবহার করতে শুরু করেন পোস্টকার্ড। এমনও দেখা যেতো যে পরিবারের কর্তা যখন বাড়ি যেতেন, সাথে নিতেন অনেক গুলো খালি পোস্টকার্ড। কাজে ফেরার আগে ওগুলোতে নিজের কর্মস্থলের নির্ভুল ঠিকানা লিখে রেখে আসতেন, যাতে বাড়ির লোকজনের সাথে যোগাযোগে কোনো সমস্যা না হয়। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষেরা এক পয়সার বিনিময়ে পেশাদার পত্রলেখককে দিয়ে পোস্টকার্ড লিখিয়েও নিতেন। চালুর মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই পোস্টকার্ড বিক্রির সংখ্যা ২৬ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।

পোস্টকার্ডের আকর্ষণ বহুগুণে বেড়ে গেলো ছবির ব্যবহারে। ভারতবর্ষের প্রথম ছবিযুক্ত পোস্টকার্ড তথা Picture postcard এর যে নমুনা পাওয়া যায় তা ১৮৯৬ সালের। প্রাথমিক যুগে এই কার্ডগুলো ছাপানো হত ভারতের বাইরে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া কিংবা জার্মানিতে। লাভজনক হওয়ায় পরবর্তীকালে স্থানীয় প্রতিষ্ঠিত ফটো স্টুডিও যেমন- বোর্ন এন্ড শেফার্ড, জন্সটন এন্ড হফম্যান, ক্যাপ এন্ড কো নিজেদের তোলা ছবি পোস্টকার্ড আকারে ছাপাতে শুরু করে। প্রথম দিকে সাদা কালো হলেও পরে ক্রোমো-লিথোগ্রাফি পদ্ধতিতে ঝকঝকে সব কার্ড তৈরি হতে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই এগুলোর দাম ছিল সাধারণ ব্যবহারকারীদের নাগালের বাইরে। তাহলে, এগুলোর ক্রেতা কারা ছিলেন? ব্রিটিশ শাসিত ভারতে তখন কর্ম ও ব্যবসা সূত্রে নানা দেশের লোকের বাস। তারা নিজ নিজ দেশে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের জন্য বেছে নিলেন এই কার্ডগুলো। কার্ডগুলোতে তাই ছবি আকারে উঠে এলো ভারতবর্ষের বিচিত্র জীবনযাত্রা, পেশা, পোশাক-আশাক আর বিশেষভাবে হিমালয় ও সংলগ্ন এলাকার অপূর্ব ভূ-প্রকৃতি। অনেকেই সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বেশি বেশি কার্ড লেনদেন করতেন। ফলে সামগ্রিকভাবেই পোস্টকার্ডের বিক্রি অনেক বেড়ে গেল। ১৯৩৮ সালের এক হিসেবে দেখা যায়, শুধুমাত্র ঐ বছরই সরকারি উদ্যোগে ২৭০ মিলিয়ন পোস্টকার্ড ছাপানো হয়।

বহু বিচিত্র বিষয়ের ছবি স্থান পেলেও ততকালীন পূর্ববঙ্গের প্রধান শহর ঢাকা এসকল পোস্টকার্ডে প্রায় উপেক্ষিতই বলা যায়। বৃহত্তর ঢাকার মূল জনগোষ্ঠী তখনও কৃষিকাজের সাথে যুক্ত ছিল। যে কারনে ব্রিটিশ ভারতে অল্প যে কয়টি পোস্টকার্ডে ঢাকা স্থান পেয়েছে সেখানে মূল বিষয় হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে এখানকার কৃষিজীবী মানুষেরা, বিশেষত পাটচাষীরা। আর হস্তশিল্পের অনবদ্য নমুনা হিসেবে Raphael Tuck &Sons এর পোস্টকার্ডে ছাপানো হয়েছে ঢাকার আহসান মঞ্জিলের ফিলিগ্রি অনুকৃতি। পাকিস্তান আমলে ছাপানো পোস্টকার্ডে বিষয় তালিকায় যুক্ত হয় লালবাগ কেল্লা, তারা মসজিদ সহ সেসময়কার কিছু নতুন নির্মিত স্থাপনা যেমন বায়তুল মোকাররম মসজিদ, ডি.আই.টি. ভবন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ইত্যাদি। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আরো যেসকল প্রতিষ্ঠান থেকে এই কার্ডগুলো ছাপানো হত তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল PIA এবং হোটেল শাহবাগ। চট্টগ্রামের স্টেশন রোডের ওয়াহিদি’স ফটোগ্রাফার এই অঞ্চলের মানুষের পেশা আর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য নিয়ে ৬৪টি পোস্টকার্ডের একটি জনপ্রিয় সিরিজ বের করে। এর ভেতরে বেশ অনেক গুলোরই বিষয় ছিল ঢাকার নানা স্থাপনা ও বুড়িগঙ্গা নদী। ঢাকার যে দু’টো ল্যান্ডমার্ক স্বাধীন বাংলাদেশে ছাপানো পোস্টকার্ডে বার বার এসেছে তার একটি হল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, অপরটি জাতীয় সংসদ ভবন।

১৯৯০এর দশকেও ঢাকার কিশোর তরুণদের মাঝে ভিউকার্ড নামে পোস্টকার্ড সংগ্রহের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। বর্তমানে তার পুরোটাই লোপ পেয়েছে। মোবাইল, স্মার্টফোন আর এস এম এস এর যুগে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আর পোস্টকার্ডের ব্যবহার সীমিত থেকে সীমিততর হয়েছে। শুধুমাত্র স্যুভেনির হিসেবে টিকে থাকার জন্য অবিক্রিত পোস্টকার্ড গুলো গুণছে তাদের শেষ দিন। আর এই পোস্টকার্ডের সাথে নিজেদের অজান্তেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি “শ্রদ্ধাস্পদেষু, “শ্রীচরণেষু’, “প্রিয়তমেষু”, “প্রীতিভাজনেষু” মতন মাতৃভাষার অপূর্ব সম্বোধন গুলোকে!

Let's share this post
error: