কাঁঠাল পাতার খাম
Written by – মিলন গাঙ্গুলী
আমাদের বাসায় চিঠি আসতো না। কেউ লিখত না আমাদের। কেউ না ।
প্রতিবেশী বাসন্তী পিসিদের বাড়িতে চিঠি আসতো। দুপুর দিকে খাকি জামা প্যান্ট পড়া একটা লোক হাজির হত কখনও কখনও। কাঁধে ওই একই রঙের ব্যাগ। পায়ে ধুলি মাখা স্যান্ডেল। হেঁড়ে গলায় ডাক দিয়ে বলতো, “চিঠি আছে, চিঠি।“
ব্যাগ থেকে হুবহু শুকনো কাঁঠাল পাতা রঙের একটা খাম বের করে দিত লোকটা।
এটা নাকি কোলকাতা থেকে এসেছে। ওখানে বাসন্তী পিসিদের কে যেন থাকে। খোঁজ খবর নেয়ার জন্য এই কাগজের টুকরাটা পাঠায়। দারুন ব্যাপার তো!
ডাকহরকরাদের আমার বেশ লাগতো। কি সুন্দর দেশে বিদেশে ঘুরে ঘুরে সবার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে আসে আর দিয়ে যায় যার চিঠি তাকে! বড় হলে আমিও ডাকহরকরা হবো।
একদিন ডাকহরকরা জেঠুর কাছে যেয়ে বললাম, “জেঠু, আমার কোনও চিঠি আছে?”
জেঠু আমার বাবাকে চিনতেন। তাই বোধহয় বললেন, “খোকা, তোমার বুঝি চিঠি আসার ছিল? তোমার কি দূরে কেউ থাকে?”
আমার দাদুর এক ভাই সেই ছোট্টোবেলায় বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আমি জানি, তিনি নিশ্চয়ই নাবিক হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান। তাই জেঠুকে বললাম, “আমার বড় দাদু তো মস্ত একজন নাবিক! তুমি তাকে বলে দিও তো, সে যেন আমাকে চিঠি লেখে!”
ডাকহরকরা জেঠু মনে হয় ভুলেই গেছে দাদুকে বলতে । আর না হলে দাদু হয়তো কোনও ঝড়ের কবলে পড়ে রবিনসন ক্রুসোর মত কোনও নির্জন দ্বীপে বন্দী!
আগুনে পুড়িয়ে লাল কাঁকড়া খাচ্ছে , সাথে নারকেলের শাঁস । কচ্ছপের ডিম।
সেইজন্য চিঠি লিখেছে না দাদু । নইলে কি আর লিখতো না ?
প্রতিবেশী পারুল দিদিরও খুব শখ ছিল একটা চিঠি পাওয়ার। দুপুরের সোনা রঙা রোদ যখন একটু ঝিমিয়ে আসতো, মা ঘুমিয়ে । আর সমস্ত পাড়ায় শুনশান নিরবতা, আমি বাড়ির পিছনের কাঁঠাল গাছের নিচে থেকে শুকনো পাতা মুঠো ভরে নিয়ে দিদির কাছে যেয়ে হেঁড়ে গলায় বলতাম, “চিঠি আছে, চি-ঠি-ইইইই।”
দিদি সেই মিথ্যা চিঠি নিয়ে মিথ্যামিথ্যি পড়তো। কখনো হেসে কুটিকুটি হতো, কখনো বা দুঃখী গলায় বলতো, “আমার সোয়ামীটার খুব অসুখ করেছে, এখন আমি কি করবো?”
আমাদের কোথাও কেউ নেই চিঠি লেখার মত।
লিখলে ভাল লাগত। খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ব্যাপার।
আমরা সেই বাসা ছেড়ে নতুন যে এলাকায় চলে গেলাম সেই এলাকার অনেকের বাড়িতে চিঠি আসতো। বেশির ভাগই মাখন রঙা খাম। দুই একজনের খাম ছিল নীলচে শাদা। নীল শাদা কেমন চিরকি মিরকি দাগ থাকতো খামের সীমানা জুড়ে। এক কোনায় একটা নীল রঙের উড়োজাহাজের ছবি দেয়া থাকতো আর নীচে লেখা থাকতো Par Avon।
এই চিঠি নাকি উড়োজাহাজে করে এখানে উড়ে এসেছে। এগুলি না কি এয়ার মেইল। যে বাড়িতে এই চিঠিগুলো আসতো, আমরা বুঝতে পারতাম যে সেই বাড়ির কেউ বিদেশে থাকে।
কল্পনার চোখে দেখতাম যে সাত সমূদ্র তের নদীর ওপারে পেল্লাই একটা সবুজ মাঠ । ঘাস ভর্তি । পাশে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলের একটা নদী, দূরে দুধ পাহাড় আর উপরে নীল আকাশ। সেই মাঠের পাশে গাছের তলায় একজন নির্বাসিত রাজকণ্যা একটা চিঠি লিখছে। তারপর সেই চিঠিটা একটা মেঘরঙা খামের মাঝে পুরে দিতেই খামের পিঠে ডানা গজিয়ে তা উড়তে শুরু করল। উড়তে উড়তে এক সময় চিঠিটা টুপ করে রাজপূত্র ডালিম কুমারের পায়ের কাছে এসে পড়ল।
আমি হতাশায় ভুগতাম।
আমাদের কেউ চিঠি লিখে না কেন?
ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় ক্লাসের সবচেয়ে নাক উঁচু ছেলেটা কেমন বিশাল একটা খাতা নিয়ে এলো।
ছেলেটার নাম ভুলে গেছি। আমরা ওকে চামচিকা বলে ডাকতাম। সামান্য মাতবরি করতো সেইজন্য এই নাম। তাছাড়া ওর শরীর ডিগডিগে ।
তো চামচিকার খাতা দেখে আমরা একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। খাতা ভর্তি খোপ খোপ দাগ। উপরে দেশের নাম। সাথে দেশের রাজধানী, জনসংখ্যা হেন তেন তথ্য দেয়া। আর সেই খোপ ভর্তি সাঁটানো রয়েছে ছোট্ট ছোট্ট রঙ্গিন সব কাগজের টুকরো। টুকরার চারিদিকে ঢেউ খেলানো ছিদ্র। এগুলিকে স্ট্যাম্প বা ডাকটিকিট বলে।
জিনিসগুলো দেখে ঈর্ষা হলেও মনে মনে খুশি হলাম ক্লাসের টিচার যখন চামচিকার কান মুচড়ে দিল।
সেই সময় আমাদের মধ্যে ডাকটিকিট জমানোর শখ একটা বেশ মহামারির মত ছড়িয়ে পড়লো।
আমার শহরে ‘মমতা বুক স্টোর’ আর ‘সানবীম বুক হাউজ’ নামে মাত্র দুটো দোকানে স্ট্যাম্প কিনতে পাওয়া যেত। দাম এক টাকা , দেড় টাকা করে। কিছু ডাকটিকিট তিন টাকা হত। সেই সব নাকি রেয়ার? রেয়ার আবার কি ? নতুন করে ছাপলেই হয়! ল্যাঠা চুকে যায়। ফাজলামো আরকি ।
তিন টাকা অনেক বেশি দাম । দশ টাকা দিয়ে তো ধাউস সাইজের আস্ত একটা ইলিশ মাছ পাওয়া যায় ।
ডাকটিকিট জমানোর নিয়ম কানুন জানি না। যেটা বেশি রঙ্গিন , সুন্দর লাগে চোখে, কিনে ফেলি।
খাতাও জোগাড় হল। জলে ভিজিয়ে খাম থেকে ডাকটিকিট তোলার কায়দা শিখলাম। জমা হতে লাগল আমার টিকিট।
কোন অজানা কারনে দেশি টিকিটের চেয়ে বিদেশী টিকিট বেশি পছন্দ হত। হয়তো সেটা মাঠের পাড়ের দূরের কোন দেশ সেইজন্য। কে জানে কেমন ওখানের মানুষ ! কাকে চিঠি লিখে ওরা?
মেট্রো-ট্রেন আর বড় বড় দালানের পাশে টাক মাথা সুচালো দাড়িওয়ালা লোকটার নাম লেনিন। মানে রাশিয়ার ডাকটিকিট। আমার কাছে এলো কি করে? ওই যে মহল্লার পিঙ্কুর বড় ভাই না লেনিনগ্রাদে থাকে? ওর কাছ থেকে না বদলা বদলি করে নিলাম। উনাকে লাল সালাম।
শাদার মধ্যে নীল ছাপের টিকিট পেলাম। রুপচাদা, চিংড়ি আর কি একটা মাছ। ভারতের টিকিট। পাঁচ পয়সা দাম।
ক্রিসমাস আইল্যান্ড নামে একটা দ্বীপ আছে। জানলাম যখন হলুদ নীল ডোরাকাটা একটা মাছের টিকিট পেলাম।
ক্রিসমাস মানে তো বড়দিন, সেই দেশে কি সারা বছরই বড়দিন থাকে? বড়দিন তো বছরের শেষে, তখন আমার আর দিদির স্কুল বন্ধ থাকে, আর এক সপ্তাহ পরই স্কুলের রেজাল্ট হয়। নতুন ক্লাস, নতুন বই আর নতুন কিছু বন্ধু। সে দেশে তবে স্কুল কখন থাকে?
নীল শাদায় ছাপা পালতোলা জাহাজের টিকিট ওটা কানাডার। একপাল হাতি হেঁটে যাচ্ছে। দেশের নাম বতসোয়ানা। পাশে ছোট্ট করে লেখা p 10.00।
মানে কি? অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম বতসোয়ানার টাকাকে পুলা বলে।
বাপরে। টিকিট জমানো তাহলে গোয়েন্দাগিরির মত জিনিস?
তখনও জমানোর কায়দা কানুন জানতাম না। টিকিটের পিছনে যে গল্প বা ইতিহাস থাকে, জানতাম না। ছবিটা পছন্দ হলেই কিনতাম। অনেক টিকিট হারিয়ে গেছে । চুরি করে নিয়ে গেছে কাছের লোকজন। বন্ধুর অভিমান ভোলানোর জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছি কত কত টিকিট ।
একটা ডাকটিকিটের কথা খুব মনে পড়ে। মাটির ভাঙ্গা একটা পাত্র পরে আছে। সেটা ভর্তি সোনার মোহর। কিছু মোহর পরে আছে ভাঙ্গা পাত্রের বাইরে । কি সুন্দর! কোন দেশের ছিল জানি না।
তোমাদের কারো কাছে সেই ডাকটিকিটটা আছে? আমাকে দেবে?
ডাকটিকিটটার কথা আজও খুব মনে পড়ে।
কেন কে জানে !
হাই স্কুলের খানিক দূরে বড় একটা পোষ্ট অফিস ছিল। কিন্তু পুরানো। লাল ইটের সুন্দর মত একটা বাড়ি। শেওলার রঙের দরজা। উপরে কাচের জ্যামিতির চাদা আকৃতি জানালা। জানালার ফ্রেম নকশা করা লোহার। জানালায় কাঠের ঝিলিমিলি । খড়খড়ি বলে ভাল বাংলায় । ইংরেজিতে ব্লাইন্ড । আমি ব্লাইন্ড বলব কেন ? ঝিলিমিলিই ভাল ।
পোস্ট আপিসের বাইরে এক গাদা লোক বসে থাকতো। সামনে খাম, টিকিট, ময়দার আঠা। আধ পুরানো মরচে পড়া একটা টাইপরাইটার টেবিলের উপর। পকেটে ঝর্ণা কলম। নিজে বসে আছে কাঁচা কাঠের চেয়ারে। সামনে নড়বড়ে টুল। উনারা চিঠি লিখে দেন।
পোষ্ট কার্ডে হলে এক টাকা। তিন পাতার কাগজে লিখে হলুদ খামে ভরে টিকিট সব সেঁটে দিলে উনাদের মজুরি পাঁচ টাকা। গরমের দুপুরে ইস্কুল থেকে ফেরার পথে দেখতাম টুলে বসে আছে মলিন জামা লুঙ্গি পরা বয়স্ক লোক। অথবা বোরখা পরা কোন মহিলা।
মিহি গলায় বলছে – ‘বাবাগো, পর সমাচার এই যে আজ বহুদিন যাবত তোমার কোন খোঁজ খবর পাই না বিধায় পত্রের মারফত কুশলাদি জানতে চাইলাম। পরম করুণাময় আল্লার দোয়ায় আশা করছি পরিবারের সকলের সহিত দিন গুজরান হচ্ছে। আমাদের দিন কোনমতে চলে যাচ্ছে …।’
উনারা বলতে বলতে কেঁদে ফেলতেন।
পত্রলেখক বলল,’ আরে কি মুশকিল। কাইন্দা কি অইব? ঠিকানা কি লিখমু কন।’
দুপুরের রোদে কেমন যেন হাহাকার আর কষ্ট মিশে থাকতো। বাউ কুড়ানি হাওয়া কেমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যেত।
তখন ওরা চিঠি লিখত। শুকনো মেপল পাতার রঙের খামে আসত ভালবাসার কথা। সুখ-দুঃখের কথা।
মায়ের অসুখে চিঠি আসত -খোকা বাড়ি আয়। চিঠি আসতো ভোজের নিমন্ত্রনে।
অলস দুপুরের রঙ হত জলপাই তেলের মত।পায়রা গুলো বাকবাকুম করত কার্নিসে বসে। ঝিম ধরা দুপুরে চিঠি গুলো বারবার পড়ত ওরা।
চিঠি পড়ত বাদলার দিনে। আকাশ ভর্তি কাকের পালকের মত মেঘ থাকত তখন। চিঠি পড়ত মখমলের মত জোসনা রাতে। চিঠি পড়ত কমলা রঙের শীতের বিকেলে। আবেগে চিঠি পড়ত। দ্রোহে চিঠি পড়ত। বিষাদের অরণ্যে হারিয়ে গিয়ে চিঠি পড়ত।
এখনও কি ওরা চিঠি লেখে আগের মত করে? এখনও কি কোনও বিরহী অপেক্ষা করে চাতকের হৃদয় নিয়ে? এখন চাইলেই পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে কোনও প্রিয়জন মূহুর্তে বিদ্যুৎ ডাকে যোগাযোগ করে তার প্রিয়জনের সাথে। সে চিঠিতে কি মিশে থাকে প্রিয়জনের কোমল ছোঁয়া?
হলুদ শীতের বিকেলগুলোতে কেমন বিবাগী লাগে। খুব ইচ্ছা হয় কেউ আমাকে চিঠি লিখুক।
শুকনো কাঁঠাল পাতার রঙের খাম। খামের মুখে শুকনো গুল্ম ফুল এঁটে উপরে তরল মোম দিয়ে সিলগালা করা একটা চিঠি আসুক আমার বাড়িতে।
কোন এক শীতের বিকেলে।
বসন্তের রিমিঝিমি কোন হাওয়ার দুপুরে।